আন্তর্জাতিক : মিয়ানমারে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ হাজার ৭শ’ জনে।
একইসঙ্গে আহতের সংখ্যা ও বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ হাজার ৫শ’ জনে। এছাড়া আরো চার শতাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের নিচে নিখোঁজ রয়েছেন। ভূমিকম্পে মিয়ানমারের মান্দালয় ও সাগাইং শহরের বহু বছরের পুরনো ৬০টিরও বেশি মসজিদ ধসে পড়েছে। একটি মসজিদে পবিত্র জু’মার নামাজ আদায় করতে ৭শ’ মুসল্লি ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৭০ জন মুসল্লিকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন ওই মসজিদটির সাবেক ইমাম সোয়ে নাই।
এছাড়া গতকাল মঙ্গলবার ৯০ ঘন্টারও বেশি সময় ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে থাকা এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করেছে দমকল কর্মীরা। ওই নারীর বয়স ৬৩ বছর। তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দেশটির দমকল বিভাগ এই খবর জানিয়েছে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার নিহতদের স্মরণে দেশব্যাপী এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়েছে। আগামী ৬ এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় পতাকা অর্ধনর্মিত রাখা হবে।
মান্দালয় থেকে এএফপি আজ এই খবর জানায়।
এদিকে ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা অভিযান অব্যাহত রেখেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। তারা বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে মানুষের জন্য জরুরিভিত্তিকে আশ্রয়, খাদ্য ও পানি জরুরি। কিন্তু দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ চলায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের কাছে সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার এক ভাষণে দেশটির সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং বলেছেন, ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ২ হাজার ৭১৯ জনে পৌঁছেছে।
স্মরণকালের ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি আরো বলেছেন, ভূমিকম্পে ৪ হাজার ৫২১ জন আহত হয়েছেন এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরো ৪৪১ জন।
গত ২৮ মার্চ শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে মিয়ানমারে পরপর দু’টি ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রথমে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার কয়েক মিনিট পরই ৬ দশমিক ৪ মাত্রার আরো একটি ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। এতে প্রতিবেশি চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামেও কম্পন অনুভূত হয়। এরমধ্যে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘মিয়ানমার নাউ’ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ফলে ইরাবতী নদীর ওপর ৯০ বছরের পুরনো ১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু ভেঙে পড়েছে। এটি মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের শহরতলির সাথে সাগাইং শহরের সংযুক্ত করেছিল।
মিয়ানমার নাউয়ের তথ্য অনুসারে, মিয়ানমারের মান্দালয় শহরে বেশ কয়েকটি ভবন ধসে পড়েছে। এসব ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে মানুষ চাপা পড়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমটি আরো জানিয়েছে, মান্দালয়ের ঐতিহাসিক একটি প্রাসাদ আংশিকভাবে ধসে পড়েছে।
জান্তা নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার তথ্য মতে, মান্দালয় অঞ্চলের ভূমিকম্পে ১ হাজার ৫৯১টি বাড়ি, ৬৭০টি মঠ, ৬০টি স্কুল, তিনটি সেতু এবং কমপক্ষে ২৯০টি প্যাগোডা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে।
এদিকে ‘দ্য ইরাবতীর’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিয়ানমারের মান্দালয় ও সাগাইং অঞ্চলে প্রায় ৬০টি মসজিদ ধসে পড়েছে। ধসে পড়া মসজিদগুলোর বেশ কয়েকটি উনিশ শতকের বলে জানা গেছে। মসজিদ ধসে অন্তত ৭শ’ জন মুসলিমের মধ্যে ১৭০ জন প্রিয় মানুষকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ এক ইমাম।
মিয়ানমারে গত শুক্রবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সাগাইং অঞ্চলের তিনটি মসজিদ মুহূর্তেই ধসে পড়ে। এই সময় মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন কয়েকশ’ মুসলমান। এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় মসজিদ মায়োমার ভেতরে থাকা প্রায় সব মুসল্লি মারা যান। মায়োমা মসজিদের সাবেক ইমাম সোয়ে নাই ১৭০ জন প্রিয় মানুষকে হারানোর শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
গত শুক্রবার মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে আজান দেয়ার সাথে সাথে শত শত মুসলিম রমজান মাসের শেষ জ’ুমার নামাজ আদায় করবেন বলে মধ্য মিয়ানমারের পাঁচটি মসজিদে ছুটে যান।
স্থানীয় সময় ১২টা ৫১ মিনিটে একটি মারাত্মক ভূমিকম্প আঘাত হানে মিয়ানমারে। মুহূর্তেই তিনটি মসজিদ ধসে পড়ে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় মসজিদটি ছিল মায়োমা। যার ভেতরে থাকা প্রায় সবাই মারা গেছেন।
কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরে থাই সীমান্তবর্তী শহর মায়ে সোতে বসে মায়োমা মসজিদের সাবেক ইমাম সোয়ে নাই ভূমিকম্পটি অনুভব করেছিলেন।
এরপর সময় বাড়ার সাথে সাথে তিনি জানতে পারলেন তার প্রায় ১৭০ জন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং তার সাবেক সহকর্মী মারা গেছেন ভূমিকম্পে। যাদের বেশিরভাগই সেই সময়টাতে মসজিদে ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
সোয়ে নাই বিবিসি’কে বলেছেন, ‘প্রাণ হারানো সবার কথা আমার মনে পড়ছে। তাদের ক্ষতিগ্রস্ত সন্তানদের কথাও। তাদের মধ্যে ছোট ছোট শিশুরাও আছে যারা তাদের পরিবারকে হারিয়েছে। এই বিষয় নিয়ে যখনই কথা বলছি আমার চোখের পানি আটকে রাখতে পারছি না।’
শুক্রবার মিয়ানমারের সাগাইং এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের কাছে ভূমিকম্প আঘাত হানে। এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে ২,৭০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বলে জানা গেছে। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনও মৃতদেহ খুঁজতে অভিযান চালাচ্ছেন। তাই সময় বাড়ার সাথে সাথে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও এই অঞ্চলটি তার প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য পরিচিত ছিল, তারপরও শহরগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীও বাস করতেন।
সোমবার দেশটির নেতা মিন অং হ্লাইং-এর দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মসজিদে নামাজ পড়ার সময় ভূমিকম্পের আঘাতে আনুমানিক ৫শ’ মুসলিম মারা গেছেন।
সাগাইংয়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা এএফপি’কে জানিয়েছেন, শহরের যে রাস্তায় মসজিদগুলো ছিল, সেই রাস্তা এবং মায়োমা স্ট্রিট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তার ওপর অনেক বাড়িঘর ধসে পড়েছে।
শুধুমাত্র মায়োমাতেই ধসে ৬০ জনেরও বেশি মানুষ চাপা পড়েন বলে জানা গেছে, অন্যদিকে মায়োডাও এবং মোয়েকিয়া মসজিদেও আরো অনেকে মারা গেছেন। মঙ্গলবারও মৃতদেহ উদ্ধার করার কাজ চলেছে।
সোয়ে নাই এর মতে, মসজিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই ঘটনার পর পালানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তার সম্প্রদায়ের বেঁচে থাকা সদস্যদের কাছ থেকে একাধিক প্রতিবেদনে খবর পেয়েছেন বলে জানান সোয়ে।
তিনি জানান, প্রধান প্রার্থনা কক্ষের বাইরে যেখানে মুসল্লিরা ওযু করেন সেখানে অনেকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। কিছু মৃতদেহ অন্যদের হাত ধরে থাকতে দেখা গেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে ভেঙে পড়া ভবন থেকে তাদের টেনে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভূমিকম্পে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে সোয়ের স্ত্রীর ভাই এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে সাবে সহকারী ইমামও ছিলেন। যাকে তিনি তার দৃঢ় কর্মনীতি এবং কোরআন তেলাওয়াতে অসাধারণ প্রতিভার জন্য স্মরণ করেছেন।
সোয়ে বলেন, যখন সম্প্রদায়ের কারো মৃত্যুর খবর তিনি শুনেছেন তখনই তিনি শোকের সাগরে ডুবে গেছেন। বিধ্বস্ত বোধ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা নিকটাত্মীয় ছিলেন না, তবুও তারা আমাকে সর্বদা স্বাগত জানাতেন। আমাকে অনুসরণ করতেন এবং আমরা এক সাথে প্রার্থনা করতাম।