
ওয়াসিম সেখ, সিরাজগঞ্জ :
সিরাজগঞ্জ শহীদ এম.মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শ্রেনীকক্ষে কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষক নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শিক্ষক ডা: রায়হান শরীফ কর্তৃক শিক্ষার্থীকে গুলি ছোড়ার ঘটনাটি গত বছরের ৪ মার্চ। ব্যাগভর্তি অস্ত্র-গুলি নিয়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানোর ঘটনায় শিক্ষক রায়হানের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ব্যাগভর্তি অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন শিক্ষক রায়হান। শিক্ষার্থী তমাল বাম উরুতে আঘাত পেলেও বর্তমানে সুস্থ্য।
অবৈধ উপায়ে সংগ্রহিত লাইসেন্সবিহীন দু’টি বিদেশী পিস্তল, দু’টি জাপানী সামুরাই, ১০টি বার্মিজ ছোড়া ও ৭৮ রাউন্ড তাজা গুলিসহ গ্রেপ্তার হন শিক্ষক রায়হান। শিক্ষার্থীর বাবা বগুড়ার আবদুল্লাহ আল আমিন ও ডিবি পুলিশ তার বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘটনাটি নিয়ে একাধিক নিউজ প্রকাশিত হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার হন শিক্ষক রায়হান। পরবর্তীতে জামিন নিয়ে পলাতক শিক্ষক রায়হান।ঘটনার পর থেকে উধাও ছিলো ‘অস্ত্র ব্যবসায়ি’ সোহাগও।
গ্রেপ্তারের পরদিন চিকিৎসক রায়হান সিরাজগঞ্জ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি ও জবানবন্ধি দেন। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার নওদাপাড়ার হারুন-অর-রশিদের ছেলে ‘হত্যা, অস্ত্র-বিস্ফোরক ও নাশকতা’মামলার আসামী এস.এস. আল হোসাইন ওরফে সোহাগের কাছ থেকে বিগত দিনে অস্ত্র কিনেছেন মর্মে স্বীকারোক্তি দেন শিক্ষক রায়হান। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে কথিত অস্ত্র ব্যবসায়ি সোহাগ ও শিক্ষক রায়হানের বিরুদ্ধে মামলা করেন সিরাজগঞ্জ ডিবি পুলিশের সাবেক এসআই ওয়াদুত আলী। শিক্ষার্থীর বাবাও শিক্ষক রায়হানকে একমাত্র আসামী করে আরেকটি মামলা করেন। দু’মাস পর আদালতে সেটির চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দেয়া হয়। দীর্ঘ তদন্তের পর সম্প্রতি অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ধারার পৃথক মামলাটির চার্জশিট দেয় ডিবি। কথিত অস্ত্র ব্যবসায়ি অভিযুক্ত সোহাগকে রহস্যজনক বাদ দিয়ে ডিবি পুলিশের চার্জশিট জমা ঘটনায় স্থানীয়ভাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশি তদন্তের নীতিমালার বাইরে গিয়ে বিধি বর্হিভুতভাবে এ কাজটি করেছেন ডিবির বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই নাজমুল হক ও ইউনিট ওসি মো: একরামুল হোসাইন। ডিবির তদন্ত ও দাখিলকৃত চার্জশিট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার বাবাও। স্বরাস্ট্র মন্ত্রানালয়, পুলিশ সদর দপ্তর ও রেঞ্জ ডিআইজির মাধ্যমে বিভাগীয় তদন্ত এবং সিআইডি-পিবিআই পুলিশ দিয়ে গ্রহনযোগ্য তদন্তেরও দাবি তাদের।
কি ঘটেছিলো সেদিন কলেজে :: ব্যাগ ভর্তি অস্ত্র, চাকুৃ ও গুলি নিয়ে ক্লাসে এসে শিক্ষার্থীদের সামনে ‘পোষাপাখি’ বলেও পিস্তল চুম খেতেন শিক্ষক রায়হান। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতেন না। সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিরুল হোসেন চোধুরীও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শুনে নিশ্চুপ থাকতেন। সেদিন দুপুরে আইটেম ক্লাস নেবার সময় অস্ত্র প্রদর্শনকালে শিক্ষার্থী তমাল প্রতিবাদ করায় শেষপর্যন্ত তার দিকে পিস্তুল তাক করে গুলি ছোড়েন শিক্ষক রায়হান।
কে এই রায়হান শরীফ : সিরাজগঞ্জ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে রায়হান মেধাবী হলেও ছোট বেলা থেকে সাইকো স্বভাবের। সবুজকানন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি, এরপর সিরাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি, শেষে রাজশাহী মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। স্কুলের সাবেক শিক্ষক আব্দুল্লাহ হীরাও গুলির ছোড়ার ঘটনায় প্রাপ্তন ছাত্র শিক্ষক রায়হানের জন্য আক্ষেপ করেন।
যেভাবে অস্ত্র যোগার হতো :: রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সংগঠনের কলেজ শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন রায়হান। চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়া অবস্থায় হলিউড ও বলিউড ফিকশন মুভি দেখে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানোর জন্য অবৈধ বিদেশ আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ জাপানী সামুরাই ও বার্মিচ চাকু সংগ্রহ করতেন। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে পড়–য়া অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের বড় ভাই সাইফুজ্জামান উপলের মাধ্যমে অস্ত্র মাফিয়ার সোহাগের দেখা পান রায়হান। দশ বছর পর সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হয়ে সোহাগের মাধ্যমে আধুনিক নতুন অস্ত্র কেনে শিক্ষক রায়হান। সোহাগই তার অস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগানদাতা। গ্রেপ্তারের পর শিক্ষক রায়হান আদালতে ১৬৪ ধ্রায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্ধী দেন, যার সকল সংগৃহীত কপি এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
বর্তমান তদন্তকারীদের কথা : : সিরাজগঞ্জ ডিবির এসআই নাজমুল হক নতুন তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলেও তিনি এ বিসয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তার ইউনিটের প্রধান বর্তমান ওসি মো: ইকরামুল হোসাইন অভিযুক্ত সোহাগকে অব্যাহতির রূপকার বলেও অভিযোগ রয়েছে। আজ ২৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে থেকে তিনি পুলিশের পিপিএম পদকও নিতে ঢাকায় গেছেন।
পদক নিতে ঢাকা যাবার আগে তিনি মুঠোফোনে দাবি করেন, ‘ডা: রায়হান আদালতে ১৬৪ ধারায় সেদিন বিচারকের সামনে সোহাগের নাম বললেও তার বাবা বা গ্রামের নাম জানাতে পারেননি। মামলার বাদি এজাহারে যে সোহাগের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেন, তিনি জড়িত নয়। বিএনপি করার কারনে এক সোহাগের বিরুদ্ধে একাধিক রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক উদ্দ্যেশে হয়রানী করতেই সাবেক পুলিশ সুপার ও ওসি পঙ্গু সোহাগকে জড়িয়েছেন। শিক্ষক রায়হান সে সময়ে অস্ত্রগুলো কিনেছিলেন, তার আগে থেকেই সোহাগ ঢাকা ও ভারতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তীতে ইমিগ্রেশন ও হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। ’
সাবেক তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কথা : সাবেক এসপি আরফিুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও মামলার বাদী ডিবির সাবেক এসআই ওয়াদুত আলী বলেন,‘আদালতে দায় স্বীকার করে চিকিৎসক রায়হান জবানবন্ধীতে ভেড়ামারার নওদাপাড়ার হারুন-অর-রশিদের ছেলে খুন,অস্ত্র-নাশকতা মামলার আসামী এস.এস. আল হোসাইন সোহাগের নাম উঠে আসে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিত