
লেখক _ মোঃ আল-মুকিদ (মাহি)
ঠাকুরগাঁওয়ের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার বাস্তবতাঃ- বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও। এখানে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষিনির্ভর গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। যদিও শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা এখনো অনেকাংশে শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ শিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা।
মূল সমস্যা ও বাস্তবচিত্র:
শিক্ষক সংকটঃ- ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ ও হরিপুর উপজেলার বেশিরভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষক মাত্র ২-৩ জন, যেখানে অন্তত ৫ জন প্রয়োজন।
অপর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও অবকাঠামোঃ- রানীশংকৈলের বেশ কিছু বিদ্যালয়ে এক কক্ষে একাধিক শ্রেণির পাঠদান এখনো প্রচলিত। অনেক স্কুলে নেই আলাদা বিজ্ঞানাগার বা গণগ্রন্থাগার।
প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহারঃ- শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় মাল্টিমিডিয়া ও স্মার্ট ক্লাস রুমের সংখ্যা কম। শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে জেলার মাত্র ৪৩% স্কুলে ডিজিটাল সরঞ্জাম পৌঁছেছে।
মেয়েদের ঝরে পড়া ও বাল্যবিয়েঃ- মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছিল ২৯.৪%।
শিশুশ্রম ও দারিদ্র্যঃ- প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা কৃষিকাজে সহায়তা করতে গিয়ে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না। এতে প্রাথমিক স্তরেই ঝরে পড়ার হার বেড়েছে।
সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ:
শিক্ষক নিয়োগ ও প্রেষণাঃ- উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং দুর্গম এলাকায় পাঠদান করলে বাড়তি আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।
ডিজিটাল অবকাঠামো সম্প্রসারণঃ- সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ই-লার্নিং কেন্দ্র, সোলার-চালিত ট্যাব ও অফলাইন ক্লাস কনটেন্ট চালু করা যেতে পারে।
কারিগরি শিক্ষা চালুঃ- ঠাকুরগাঁওয়ের মতো কৃষিনির্ভর জেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে কৃষি, মৎস্য ও পশু পালনভিত্তিক কারিগরি শিক্ষার কার্যক্রম চালু করলে শিক্ষার্থীরা স্থানীয়ভাবে কাজের দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ যাতায়াত ও উপবৃত্তিঃ- নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা (যেমন: বাইসাইকেল প্রদান, স্কুলবাস) এবং উপবৃত্তি কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।
অভিভাবক সচেতনতামূলক উদ্যোগঃ- গ্রামে গ্রামে সচেতনতা সভা, ‘মা সমাবেশ’ ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র (ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা অফিস, ২০২৫)
প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিতঃ- ৩২% প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে সীমাবদ্ধতাঃ- ৫৭% বিদ্যালয়ে। আইসিটি প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকঃ- ৬৫%। মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়া হারঃ- ২৯.৪%। শৌচাগার অনুপযুক্ত/অকার্যকরঃ- ১৫% বিদ্যালয়ে।
ঠাকুরগাঁও জেলার গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংকটগুলো রয়েছে, তা শুধু স্থানীয় প্রশাসনের নয়—সমগ্র জাতির অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। শিক্ষা যদি মানুষের মৌলিক অধিকার হয়, তবে তার মান ও সুযোগ সুবিধাও হতে হবে সর্বজনীন এবং মানসম্মত। সরকারি পদক্ষেপ, সামাজিক সচেতনতা ও প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার একত্রে প্রয়োগ করা গেলে গ্রামীণ শিক্ষার চেহারা বদলে যেতে পারে। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি শিশুর মুখে বইয়ের আলো ছড়িয়ে দিতে হলে এখনই সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।