
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
আগে জাতীয়, নাকি স্থানীয় নির্বাচন—এমন বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানো নিয়ে আন্দোলন। এসব আন্দোলন-বিতর্কের মধ্যেই ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার! এই নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিতে যাচ্ছে বলে একাধিক সূত্র কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে।
সূত্রগুলো বলছে, ডিএসসিসি নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং দুই সিটির নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় সংকট নিরসনে সরকার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের এমন উদ্যোগ নিচ্ছে। আইন অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা দিলেই ভোটের উদ্যোগ নিয়ে থাকে ইসি। ইসিও বলছে, আগে কোন নির্বাচন হবে, সেটা সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন শুধু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর ধারা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করায় নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই সরকার মনে করছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া খুবই জরুরি। তাই স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে এই নির্বাচন আয়োজনে চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে চিঠির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।’
এর আগে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন চেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনকে চিঠি দিয়েছেন এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে চিঠিতে জুলাই আন্দোলনের সংগঠক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মী বলে দাবি করেছেন। গত মঙ্গলবার ইসির প্রাপ্তি ও জারি শাখায় চিঠিটি জমা দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। চিঠিতে বলা হয়, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত দুই কোটি জনগণ বাস করে। যদি নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকে তাহলে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোগান্তির আর শেষ থাকে না। নির্বাচন না দিয়ে জনগণের দৈনন্দিন নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে এবং মারাত্মক জটিলতা তৈরি করছে, যা নগর গঠনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। অতএব, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হইল।’
অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুপারিশ করেছিল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এ লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার জন্য আইন সংশোধন করারও সুপারিশ করেছে এই কমিশন। তবে বিএনপি ও সমমনাদের দাবি, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো স্থানীয় নির্বাচন নয়। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। যদিও সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলে আসছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের এমন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
এদিকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন তার সমর্থকরা। নগর ভবনে তালা লাগিয়ে ইশরাক সমর্থকদের অবরোধের কারণে দক্ষিণ সিটি কার্যালয়ে কার্যত অচলাবস্থার তৈরি হয়েছে। আন্দোলনের ফলে নাগরিক ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। নগর ভবনের কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে নগর ভবন তালাবদ্ধ থাকায় ভবনের ভেতরের সব সেবা বন্ধের পাশাপাশি যে আটটি আঞ্চলিক অফিস নগর ভবনের বাইরে রয়েছে সেগুলোও বন্ধ রয়েছে।
ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘কয়েকদিন ধরেই নগর ভবনের ভেতরকার সব নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। নগর ভবনের বাইরের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোও বন্ধ রয়েছে। এর ফলে আমরা কোনো নাগরিক সেবা ঢাকা দক্ষিণ সিটির নাগরিকদের দিতে পারছি না।’
ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে মো. শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়াদ শুরু হয় ২০২০ সালের ১৬ মে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুদিন আগেই তাপস দেশ থেকে পালিয়ে যান।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালের ১৬ মে। গত ৫ আগস্টের পরে তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। পরে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। এমন বাস্তবতায় গত বছরের ১৯ আগস্ট দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যকালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে গত ১৫ মে।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস বিএনপির ইশরাক হোসেনকে প্রায় পৌনে দুই লাখ ভোটে পরাজিত করেন। তবে চলতি বছরের ২৭ মার্চ একটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল সেই ফল বাতিল করে ইশরাক হোসেনকে বৈধ মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের পরদিন সুপ্রিম কোর্টের দুজন আইনজীবী একটি লিগ্যাল নোটিশ দেন। পরদিন ২৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদের পাঠানো একটি লিগ্যাল নোটিশে আলোচিত রায় ও শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। এ নিয়ে রিট করা হয় হাইকোর্টে। কমিশনের দেওয়া গেজেট স্থগিত চেয়ে রিটের ওপর গত মঙ্গলবার শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে আজ বৃহস্পতিবার আদেশ দেবেন আদালত।
নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু এই শপথের তারিখ ঘোষণা ঘিরেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ইশরাক সমর্থকরা। এখন পর্যন্ত মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেন শপথ নিতে পারবেন কি না, সেটি স্পষ্ট করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, যেহেতু নানা ধরনের আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে, মেয়াদ-সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে, এই জটিলতা নিরসনে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছি। তিনি বলছেন, আদালতে আইনি লড়াই লড়তে হবে এবং যেসব জটিলতা আছে সেগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।
এদিকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন কমিশনের সামনেই বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে এনসিপি। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হওয়ায় সারা দেশে নাগরিক সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরকারি প্রশাসনিক কার্যালয়গুলো একটি দলের দখলে চলে যাচ্ছে। ডিএসসিসির অচলাবস্থার জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী। তাদের এ রায়ের (দক্ষিণ সিটির মেয়র নির্বাচন) বিরুদ্ধে আপিল করার কথা ছিল। কিন্তু তারা কোনো রহস্যজনক কারণে মামলার বিবাদী হওয়ার পরও আপিল না করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এ মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনেই একমাত্র সমাধান।
সিটি করপোরেশনের চলমান সংকট ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গতকাল রাতে কালবেলাকে বলেন, ‘জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। এই সংকট সমাধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা কাজ করছি। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে আমরা বিষয়টি জানাব।’
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচন কোনটা আগে হবে এবং কোনটা পরে হবে এটা নির্বাচন কমিশনের হাতে নেই। সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে কোন নির্বাচন আগে এবং কোনটি পরে হবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন আয়োজন করা।(’সুত্র-কালবেলা)